এখন পর্যন্ত এ খবরটি সর্বমোট দেখা হয়েছে 973
ডালিয়া শারমিন
প্রভাষক
চুয়াডাঙ্গা পৌর ডিগ্রি কলেজ,চুয়াডাঙ্গা
খুব ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল মার। অলস দুপুরে বহুদিন শুনেছি মার মুখে এইসব কথা। যখন মা ক্লাস ফোরে, বাবা তখন ভি,জে স্কুলে ক্লাস নাইনে!
পাশাপাশি গ্রাম, দলকা লক্ষীপুর ও টুনি গোপালপুরের দু মেম্বার, তাদের ভিতর চরম বন্ধুত্ম থাকায়, তা পাকাপোক্ত করতেই এই বাল্যবিবাহ!
মার মুখে শুনে মার পায়ের কাছে গড়িয়ে গড়িয়ে হাসতাম;যেদিন মার বিয়ে, বাবা,চাচা,ঘটকসহ বেশকিছু আত্মীয় নানা বাড়িতে গেলে,নাস্তা শেষে মোটা খাসি জবাই করে বড় ডেকচিতে বাবুর্চি রান্না করছে,আমার মা আমার চাচার সাথে খেলা করছে।চাচা তখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি যদিও, তবও সে জানে কেন তারা ওখানে গেছে, অথচ-যার বিয়ে সেই জানেনা কি ঘটে যাচ্ছে? চাচাকে মা জিজ্ঞেস করছে-
এই তোরা কি করতে এসেছিস রে? চাচা তখন বলছে যে,আমার ভাই বিয়ে করতে এসছে।
এভাবে মায়ের বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল।মা ভেবেছিলেন ছোট বোনদের নিয়ে হয়তো কদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছেন।পরে বুঝতে শুরু করলেন একটু একটু করে যে,মনের অজান্তে নিজেকে শক্ত এক বাঁধনে বেঁধে ফেলেছেন।
শুরু হলো কৈশোর ছয় ফুপু আর ছোট দুষ্টু-মিষ্টি সেই দেবরকে নিয়ে।
বাবার সাথে দেখাটা কমই হতো,কেননা গ্রাম থেকে এসে চুয়াডাঙ্গায় ক্লাস করা কঠিন ছিল। তখন রাস্তা ঘাট খুবই খারাপ ছিল। গাড়ি -ঘোড়া বলতে ছিল- গরুর গাড়ি আর মহিষের গাড়ি।
পরে,রামনগর এ এক চাঁচত বোন,ছামিরন সম্পর্কে আমার ফুপু, তার কাছে থেকে চুয়াডাঙ্গায় পড়াশোনা শুরু হয়। এই ভদ্র মহিলা ছিলেন সেই সময়ে দুর্দান্ত বৈষয়িক ক্ষমতার অধিকারী এক মহিলা। বাবা ও ওই ফুপুর মধ্যে দারুণ সম্পর্ক ছিল শেষ অবধি।
যা হোক,বাবার পড়াশোনা চলমান অবস্থায় আমার বড় দু ভাই বোন জন্ম গ্রহন করে।ছয় ফুফু,বাবা চাচা,মা আর আমার ভাই বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব আমার দাদার উপরে ছিল। আমার নানার তখন কোন পুএ সন্তান ছিল না।তিনি আমার বাবাকে পুএস্নেহে বড় করেছেন,দাদা মারা যাবার পরে সবসময়ই বাবার পাশে থেকেছেন।মার মুখে আরো মজার মজার কথা শুনে হেসেছি।দাদা স্কুলে শিক্ষকদের কাছে চকলেট রেখে আসতেন আমার দুষ্টু ভাই বোন স্কুলে যেতে চাইতোনা বলে। আমার ভাই বোনেরা স্কুলে যেত পড়তে না,চকলেট আর বিলাতি দুধের লোভে।
আমার যখন বয়স এক মাস,বাবা ইন্জিনিয়ারিং পাস করে প্রথম গাইবান্ধাতে চাকরি পেয়ে ছোট চাচা,ছোট ফুফু,এক খালাসহ আমাদেরকে নিয়ে যান।শুরু হলো গ্রাম্য জীবন থেকে শহুরে জীবন।
এরপর রংপুর, ফরিদপুর,চিটাগং, কুমিল্লা থেকে বাবা ঢাকায় আসলেন।শুরু হলো রঙিন রাজধানীতে রঙিন জীবন। বড় হতে শিখলাম, বুঝতে শিখলাম, জীবনকে যখন উপভোগ করতে শিখলাম,উনিশ বছর বয়সে আচমকা একদিন কালবৈশাখী ঝড়ে সব ভেঙে গুড়িয়ে গেল! মা আমার দুর্দান্ত যৌবনে মাএ আটএিশ বছর বয়সে বিধবা হলেন!
সেই এ্যাকসিডেন্টে বাবা ও ছোট ভাইটা মারা যায়, আমরা দুবোন বেঁচে যায়। সাতাশ দিন পর জানতে পেরছিলাম তারা পৃথিবীতে নেই।
অর্থনীতির মত একটা সাবজেক্টে তিন ভাই বোনের পড়াশোনা একটা বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্টে থেকে মুশকিল ছিল। মানুষ যা ভাবে সবসময় তা হয়না! আল্লাহ যা ভেবে রাখেন মানুষ তা জানেনা।বাবার এম.ডি সেলিম আঙ্কেল পাশে এসে দাড়ালেন। বাবার একমাত্র ছোট ভাই আমার ছোটাব্বা,আর ঢাকার এক খালা, যে কিনা আমাদের দুবোনকে সারিয়ে তোলার জন্য মার সংসারে দুবছর ছিলেন। এদেরকে নিয়ে মা এ যুদ্ধে জয়ী হলেন।
তিন ভাই বোন লেখা পড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হবার পরে আটান্ন বছর বয়সে মা আমার চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে।
বুকের ভিতরে শুন্যতা আর হাহাকারে মাঝে মাঝে ভাবি আনমনে,বাবা গেলে মা থাকে,মা গেলে বাবা থাকে,মা বাবা কেও আর রইল না।একদিন এক এক করে আমাদের ও যেতে হবে এপার ছেড়ে ওপারে।
অল্প বয়সে বিধবা হবার পরে মা আমার তিন সন্তান কে নিয়ে এক মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন,ইচ্ছে ছিল নাতি পুতিনের সাথে বিশ্ব জয় করবেন।তাদের সাথে আর ঘোরা হলনা।
মা আমার বলেছিল –
কাদবিনা,হেসে গোসল করিয়ে বিদায় দিবি।আমি সেদিন হাসতে পারিনি,চিৎকার করে করে প্রলাপ বকেছিলাম,দোয়া পড়ে পড়ে শেষ গোসলে অংশ নিয়েছিলাম,অতঃপর চিরবিদায় দিয়েছিলাম।
বিবাহিত জীবনের বাল্যবেলা থেকে শুরু করে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে বিধবা হয়ে আমাদের হাত শক্ত করে ধরে তুমি যে মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলে মাগো,তার পরম পুরস্কার তুমি নিশ্চয়ই পাবে।মহান আল্লাহ তালা যেন তোমাকে শ্রেষ্ঠ জান্নাতের বাসিন্দা করেন মাগো।
মতামত জানান