১২:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৫ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আলোর পথে নির্ভীক পথিক: শহীদ মুহা. রফিকুল ইসলাম

 

‘আমি হতাশাকে পছন্দ করি না, আমি চাই আমার জীবন হোক ভোঁরের সূর্যের মতো আলোকময়’—নিজের ডায়েরিতে লেখা এই উক্তিটিকে সত্য প্রমাণ করে শহীদ মুহা. রফিকুল ইসলাম মাত্র ২১ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করে ১০ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা হল্ট স্টেশনের কাছে ক্ষমতাসীন সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাহিনীর গুলিতে তিনি শহীদ হন।

শাহাদাতের ঘটনা

কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ দেলাওয়ার হোসেনের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি দর্শনা বাজার বটতলা মোড় থেকে শুরু হয়ে দর্শনা বাস স্ট্যান্ড মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয় এবং সেখানেই সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা হয়।

কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ বিনা উস্কানিতে নিরীহ শিবির কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং পেছন দিক থেকে ধাওয়া করে। দর্শনা হল্ট স্টেশনের গেটে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ বাহিনী ২২/২৫ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। প্রকাশ্যে দিবালোকে এই হামলায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন দেশপ্রেমিক তরুণ ছাত্রনেতা মুহা. রফিকুল ইসলাম। দুপুর ৩.২০ মিনিটে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে জান্নাতের পাখি হয়ে উড়ে যান। এছাড়াও এই হামলায় আরও ৫ জন আহত হন।

শাহাদাতের পর পুলিশ সুপার আব্দুর রহিম শাহ্ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য প্রচার করেন যে, ঘটনাস্থল থেকে ১ কিলোমিটার দূরের কেরুজ মন্দিরে জামায়াত-শিবির হামলা চালালে তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে গুলি করলে একজন মারা যায়। তবে এই বানোয়াট মিথ্যাচার শুনে এলাকার সাধারণ মানুষ হতবাক হন। উল্টো পুলিশই হত্যা দায় এড়াতে দামুড়হুদা থানায় এস আই আফজাল হোসেন বাদী হয়ে ৬৩৯ জন নেতা-কর্মীর (মহিলাসহ) নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

আত্মত্যাগ ও আদর্শ

শহীদ রফিকুল ইসলাম ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্র এবং সংগঠনের একজন নিবেদিত সাথী। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর থানার বোয়ালিয়া গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক মো: দেলোয়ার হোসেন ও রহিমা খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।

দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি ছিলেন অকুতোভয় একজন সৈনিক এবং কঠোর পরিশ্রমী। সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে তাকে কখনও ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি। ১৭ আগস্ট ২০১৩, তাঁর সাথী শপথের কন্ট্রাক্টের দিনও তিনি অন্যের জমিতে ভূট্রার ক্ষেতে কাজ করছিলেন। কাজ ও কর্মসূচির মাঝে দ্বন্দ্বে তিনি ক্ষেতের কাজ ফেলে রেখে বেলা ১১টার সময় এসে সাথী শপথ গ্রহণ করেন।

তাঁর ডায়েরিতে তিনি আত্মসমালোচনা ও দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখে রাখতেন, যা তার মিতব্যয়িতা ও সচেতনার প্রমাণ দেয়। এক সময় কর্মী আলোচনা চক্রে নেতার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সকল প্রকার খারাপ কাজ পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের জীবন আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেন।

ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন: “জানি না খোদা কি কারণে দুনিয়ার জীবন এত কঠিন লাগে, আল্লাহ্ তুমি দয়া করো আমার প্রতি, আমাকে সকল হতাশা থেকে মুক্তি দাও, সে পথ যে পথ সত্য ও সুন্দর।”

গর্বিত পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া

শহীদের পিতা, দরিদ্র ভ্যানচালক মুহা. দেলোয়ার হোসেন, পরদিন জানাজার পূর্বে হাজার হাজার তৌহিদী জনতার সামনে বলেন, “আমার অনার্স পড়া একমাত্র বুকের মানিক, আশার প্রদীপটিকে কোনো অপরাধে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলো। আমার সেই স্বপ্ন পুলিশের হায়েনা বাহিনী গুলি করে নিঃশেষ করে দিল। আমার ছেলে কোনো খারাপ কাজ করতে যায়নি, সে গিয়েছে ইসলামী আন্দোলনের মিছিলে সরকারের ইসলাম বিদ্বেষী কাজের প্রতিবাদ জানাতে।” তিনি উপস্থিত সকলকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার এবং প্রয়োজনে জীবন দেওয়ার আহ্বান জানান।

শহীদের মা রহিমা খাতুন গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে বলেন, তাঁর ছেলে প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করে দিনের কাজ শুরু করতো এবং তাকে ঘরের কাজেও সহযোগিতা করতো। তিনি জানান, মিছিলে যাওয়ার পূর্ব রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে তার ছেলে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে—সেই স্বপ্নই সত্যি হলো। তিনি আরও জানান যে, তাঁর স্বামীই ছেলেকে মিছিলে যেতে উৎসাহিত করে বলেছিলেন, “এতে যদি শহীদ হয় তবুও আমার কোনো আপত্তি নেই, আমি শহীদের গর্বিত পিতা হবো।”

শহীদ মুহা. রফিকুল ইসলাম আজ লক্ষ লক্ষ মুজাহিদের হৃদয়ে শহীদি তামান্নার অনুপ্রেরণা হয়ে রইলেন, যিনি ভোরের সূর্যের মতো আলোকময় জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই পথে নিজেকে উৎসর্গ করে গেলেন।

শাহাদাতের তারিখ ও সময়: ১০ অক্টোবর ২০১৩ (বেলা ৩.২০ মিনিট)

যাদের আঘাতে শহীদ: পুলিশ কর্তৃক মাথায় গুলি

শাহাদাতের স্থান: দর্শনা হল্ট স্টেশন

জনপ্রিয়

দামুড়হুদায় পুকুরে গ্যাস ট্যাবলেট দিয়ে ৬ লাখ টাকার মাছ মেরে ফেলল দুর্বৃত্তরা

আলোর পথে নির্ভীক পথিক: শহীদ মুহা. রফিকুল ইসলাম

Update Time : ১০:০৬:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

 

‘আমি হতাশাকে পছন্দ করি না, আমি চাই আমার জীবন হোক ভোঁরের সূর্যের মতো আলোকময়’—নিজের ডায়েরিতে লেখা এই উক্তিটিকে সত্য প্রমাণ করে শহীদ মুহা. রফিকুল ইসলাম মাত্র ২১ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করে ১০ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা হল্ট স্টেশনের কাছে ক্ষমতাসীন সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাহিনীর গুলিতে তিনি শহীদ হন।

শাহাদাতের ঘটনা

কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ দেলাওয়ার হোসেনের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি দর্শনা বাজার বটতলা মোড় থেকে শুরু হয়ে দর্শনা বাস স্ট্যান্ড মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয় এবং সেখানেই সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা হয়।

কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ বিনা উস্কানিতে নিরীহ শিবির কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং পেছন দিক থেকে ধাওয়া করে। দর্শনা হল্ট স্টেশনের গেটে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ বাহিনী ২২/২৫ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। প্রকাশ্যে দিবালোকে এই হামলায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন দেশপ্রেমিক তরুণ ছাত্রনেতা মুহা. রফিকুল ইসলাম। দুপুর ৩.২০ মিনিটে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে জান্নাতের পাখি হয়ে উড়ে যান। এছাড়াও এই হামলায় আরও ৫ জন আহত হন।

শাহাদাতের পর পুলিশ সুপার আব্দুর রহিম শাহ্ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য প্রচার করেন যে, ঘটনাস্থল থেকে ১ কিলোমিটার দূরের কেরুজ মন্দিরে জামায়াত-শিবির হামলা চালালে তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে গুলি করলে একজন মারা যায়। তবে এই বানোয়াট মিথ্যাচার শুনে এলাকার সাধারণ মানুষ হতবাক হন। উল্টো পুলিশই হত্যা দায় এড়াতে দামুড়হুদা থানায় এস আই আফজাল হোসেন বাদী হয়ে ৬৩৯ জন নেতা-কর্মীর (মহিলাসহ) নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

আত্মত্যাগ ও আদর্শ

শহীদ রফিকুল ইসলাম ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্র এবং সংগঠনের একজন নিবেদিত সাথী। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলার সদর থানার বোয়ালিয়া গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক মো: দেলোয়ার হোসেন ও রহিমা খাতুনের দুই ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।

দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি ছিলেন অকুতোভয় একজন সৈনিক এবং কঠোর পরিশ্রমী। সংগঠনের কাজ করতে গিয়ে তাকে কখনও ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি। ১৭ আগস্ট ২০১৩, তাঁর সাথী শপথের কন্ট্রাক্টের দিনও তিনি অন্যের জমিতে ভূট্রার ক্ষেতে কাজ করছিলেন। কাজ ও কর্মসূচির মাঝে দ্বন্দ্বে তিনি ক্ষেতের কাজ ফেলে রেখে বেলা ১১টার সময় এসে সাথী শপথ গ্রহণ করেন।

তাঁর ডায়েরিতে তিনি আত্মসমালোচনা ও দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখে রাখতেন, যা তার মিতব্যয়িতা ও সচেতনার প্রমাণ দেয়। এক সময় কর্মী আলোচনা চক্রে নেতার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সকল প্রকার খারাপ কাজ পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের জীবন আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেন।

ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন: “জানি না খোদা কি কারণে দুনিয়ার জীবন এত কঠিন লাগে, আল্লাহ্ তুমি দয়া করো আমার প্রতি, আমাকে সকল হতাশা থেকে মুক্তি দাও, সে পথ যে পথ সত্য ও সুন্দর।”

গর্বিত পিতা-মাতার প্রতিক্রিয়া

শহীদের পিতা, দরিদ্র ভ্যানচালক মুহা. দেলোয়ার হোসেন, পরদিন জানাজার পূর্বে হাজার হাজার তৌহিদী জনতার সামনে বলেন, “আমার অনার্স পড়া একমাত্র বুকের মানিক, আশার প্রদীপটিকে কোনো অপরাধে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলো। আমার সেই স্বপ্ন পুলিশের হায়েনা বাহিনী গুলি করে নিঃশেষ করে দিল। আমার ছেলে কোনো খারাপ কাজ করতে যায়নি, সে গিয়েছে ইসলামী আন্দোলনের মিছিলে সরকারের ইসলাম বিদ্বেষী কাজের প্রতিবাদ জানাতে।” তিনি উপস্থিত সকলকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার এবং প্রয়োজনে জীবন দেওয়ার আহ্বান জানান।

শহীদের মা রহিমা খাতুন গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে বলেন, তাঁর ছেলে প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করে দিনের কাজ শুরু করতো এবং তাকে ঘরের কাজেও সহযোগিতা করতো। তিনি জানান, মিছিলে যাওয়ার পূর্ব রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে তার ছেলে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে—সেই স্বপ্নই সত্যি হলো। তিনি আরও জানান যে, তাঁর স্বামীই ছেলেকে মিছিলে যেতে উৎসাহিত করে বলেছিলেন, “এতে যদি শহীদ হয় তবুও আমার কোনো আপত্তি নেই, আমি শহীদের গর্বিত পিতা হবো।”

শহীদ মুহা. রফিকুল ইসলাম আজ লক্ষ লক্ষ মুজাহিদের হৃদয়ে শহীদি তামান্নার অনুপ্রেরণা হয়ে রইলেন, যিনি ভোরের সূর্যের মতো আলোকময় জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই পথে নিজেকে উৎসর্গ করে গেলেন।

শাহাদাতের তারিখ ও সময়: ১০ অক্টোবর ২০১৩ (বেলা ৩.২০ মিনিট)

যাদের আঘাতে শহীদ: পুলিশ কর্তৃক মাথায় গুলি

শাহাদাতের স্থান: দর্শনা হল্ট স্টেশন