হংকং থেকে পরিচালিত ক্লিনো ইমেক্স (ঈষবধহড় ওগঊঢ) ট্রেডিং সাইটে টাকা জমা রাখলে দ্বিগুণ মুনাফা হবে, এমন প্রলোভনে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের প্রায় ৪ শতাধিক পরিবার প্রতারণার শিকার হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। মুনাফার আশায় ধার-দেনা ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এখন তারা দিশেহারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বোয়ালিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল লতিফের ছোট ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী আশিক (২২) প্রায় চার মাস আগে গ্রামের মাবুদের ছেলে নিরব হোসেন ও কুরবান আলীর ছেলে আকাশ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, একটা অনলাইন সাইট আছে, যেখানে বসে থেকেই টাকা ইনভেস্ট করে প্রতিদিন অনেক টাকা ইনকাম করা যায়। ১০০ টাকা জমা করলে প্রতিদিন ৪ টাকা লাভ পাওয়া যায়। আশিকের এমন আশ্বাসে নিরব ও আকাশ ওই সাইটে কাজ শুরু করে টাকা ইনকাম করতে থাকে। কিছুদিন কাজ করে টাকা ইনকাম করার পর নিরব ও আশিক গ্রামের ফজুর ছেলে হৃদয়, মোহাবতের ছেলে তানভির, পচার ছেলে সুজন, মোল্লার ছেলে রাজকে সাথে নিয়ে মোট ৭টি টিম তৈরি করে এবং টাকা ইনকামের কথা গ্রামে প্রচার করে মানুষকে প্রলোভন দেখাতে থাকে।
এদের প্রলোভনে বোয়ালিয়াসহ আশেপাশের গ্রাম বিশেষ করে শ্রীকোল, নেহালপুর, হিজলগাড়ী, বলদিয়া, বড়শলুয়া গ্রামের একাধিক ব্যক্তি আকাশ ও নিরবের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে টাকা জমা করে লাভ পেতে থাকেন। পৃথকভাবে হোয়াটসঅ্যাপ ভিত্তিক গ্রুপ খুলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতো নিরব, আকাশ, ও আশিক। শুধুমাত্র নিরবের গ্রুপেই ছিল ২১৮ জন সদস্য। নিজের ইনভেস্ট ও কমিশনের টাকা মিলে প্রতিদিন নিরব ও আকাশ ওই সাইট থেকে ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করত, যা তারা কমিশন বা পারসেন্টেজ হিসেবে পেত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সাইটে সাড়ে ৩ লাখ টাকা ইনভেস্ট করা বোয়ালিয়া গ্রামের এক কৃষক বলেন, ‘আমার ছেলের কাছ থেকে জানতে পারলাম ইন্টারনেটে টাকা জমা রাখলে নাকি দ্বিগুণ টাকা ইনকাম হচ্ছে। প্রথম দিকে বিশ্বাস না করলেও গ্রামের অনেকজনের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর সেখানে হালের গরু বিক্রি ও নিজের জমানো টাকা মিলে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিই। আজ সকালে শুনছি সবকিছু হারিয়ে গেছে।’
বোয়ালিয়া গ্রামের কালাম ভান্ডরীর ছেলে কালাম বলেন, ‘টাকা দ্বিগুণের আশায় নিজের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম পাখিভ্যান বিক্রি করে সেখানে টাকা রেখে আমি এখন পথের ফকির।’ একই গ্রামের ইজিবাইক চালক মিজানুর বলেন, ‘আমি আমার ছোট ভাইয়ের কথামতো ওই সাইটে ১৮ হাজার টাকা জমা করি। এখন পুরোটাই গায়েব হয়ে গেছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র বোয়ালিয়া গ্রামের ২ শতাধিক ব্যক্তি ক্লিনো ইমেক্সে ট্রেডিং সাইটে প্রায় ৬ কোটি টাকা জমা রেখেছিল। এছাড়া শ্রীকোল, নেহালপুর, কুন্দিপুর, হিজলগাড়ী, বলদিয়া, বড়শলুয়া গ্রামের ৪ শতাধিক পরিবার এই সাইটে দ্বিগুণের আশায় প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে ইনভেস্ট করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোয়ালিয়া গ্রামের আমিনুরের ছেলে শামীম, ইদবারীর ছেলে ফরিদ, কালামের ছেলে সোহাগ, হেদনের ছেলে হাসিবুল, পচার ছেলে সুজন, মওলার ছেলে রাজ, কলিম উদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব, সজিবের ছেলে সোনা মিয়া, ডিস নাজমুল, সাইফুলের ছেলে রকিব, ফজুর ছেলে হৃদয়, হোটেল শিমুলসহ বোয়ালিয়া গ্রামের নারী, পুরুষরা ঝাঁক বেধে ক্লিনো ইমেক্স ট্রেডিং সাইটে টাকা জমা করে।
বোয়ালিয়া গ্রামের শাহীন নামে একজন এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘গ্রামের সহজ সরল মানুষ, কেউ হালের গরু, গাভিসহ বাছুর গরু, স্ত্রীর গহনা, এনজিও থেকে ঋণ, গ্রামের দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ অথবা মোটরসাইকেল, পাখিভ্যান এমনকি জমি বন্ধক রেখে দ্বিগুণ লাভের আশায় ওই সাইটে টাকা জমা করে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সাইটটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে গ্রামজুড়ে হাহাকার শুরু হয়।’
এদিকে সূত্রমতে তথ্য নিয়ে ভুক্তভোগী একাধিক নারী-পুরুষের সাথে কথা বলতে চাইলেও পুলিশি ঝামেলা, সামাজিক মান-সম্মানের ভয়ে অধিকাংশ ভুক্তভোগী ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। গতকাল সোমবার সকাল থেকে বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রামের মাসুম রেজা নামে একজন বলেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি, যেখানে আমি আমার অনেক পরিচিতদের সতর্ক করেছিলাম, কিন্তু তারা আমার পরামর্শ শোনেনি। তারা আজ একটি বড় ক্ষতির সম্মুখীন। এটি হলো ‘ক্লিনো ইমেক্স’ নামক একটি ফ্রডালেন্ট ওয়েবসাইটের ঘটনা। এখন তারা খুবই খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন।’
অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ক্লিনো ইমেক্স থেকে গ্রামের কেউ প্রকৃত অর্থে কোনো আয় করতে না পারলেও নিরব ও আকাশ- এই দুইজনের নামে প্রায় ২ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে। ভুক্তভোগীর ক্লিনো ইমেক্স চক্রের অন্যতম হোতা বোয়ালিয়া গ্রামের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী আশিক ও তার ৭ জন সহযোগীকে আইনের আওতায় এনে ভুক্তভোগীদের টাকা উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।




















